বিয়ের প্রতিশ্রুতি, শারীরিক সম্পর্ক, অতঃপর

0
60
বিয়ের প্রতিশ্রুতি, শারীরিক সম্পর্ক, অতঃপর
বিয়ের প্রতিশ্রুতি, শারীরিক সম্পর্ক, অতঃপর

বিয়ের প্রতিশ্রুতি, শারীরিক সম্পর্ক, অতঃপর

প্রেম ও পরিণয় এক নয়। ভালোবাসা ও বিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ‘শিরঃপীড়া’। যে মানুষটির সঙ্গে প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে ছাদনাতলায় যেতেই হবে– এমন কোনো আইন অন্তত বাংলাদেশে নেই। কিন্তু পত্রিকার পাতা খুললে ‘বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন’ এবং অতঃপর প্রতারণার খবর প্রায়ই চোখে পড়ে।

স্থান, কাল, পাত্র ভেদ হয়, কিন্তু খবরের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই রকম থাকে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি অথবা প্রলোভন। দুজন মানুষের তথা নর-নারীর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন। এরপর পুরুষটির বিয়েতে অস্বীকৃতি, নারীটি ক্ষুব্ধ। বিষয়টি যদি মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায় তাহলে এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ধর্ষণ মামলা করা হয়। কিছু কিছু ঘটনায় আমরা নারীটির আত্মহত্যার মতো বিয়োগান্তক পরিস্থিতিও দেখি।

সম্প্রতি প্রয়াত একজন আবৃত্তিকারের বিরুদ্ধে প্রেমের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং এর ফলে একজন নারীর আত্মহত্যার গুঞ্জন শোনা যায়। কয়েক বছর আগে একজন ক্রিকেট তারকার বিরুদ্ধে তাঁর সাবেক প্রেমিকার ধর্ষণ মামলার জের ধরে মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। এমন আরও অনেক অনেক ঘটনা চারপাশে রয়েছে।

দুজন মানুষের পারষ্পরিক আবেগ ও আকর্ষণ থেকে প্রেমের সূচনা। সেই আকর্ষণ মানসিক ও শারীরিক মিশ্রিত হতে পারে অথবা পৃথকও হতে পারে। প্রেমজ আকর্ষণ যখন শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়, তখন সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় পারস্পরিক সম্মতিতে। পরবর্তীতে আবেগ ও আকর্ষণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে; সেটিও খুব স্বাভাবিক। এমনকি সম্পর্ক ভেঙে যেতেও পারে।

কাউকে ভালোবাসলে তাকে সারা জীবন ভালোবাসতেই হবে– এমন কোনো দাসখত তো কোনো প্রেমেই দেওয়া হয় না; সেটা সম্ভবও নয়। দুজনেই যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন তাহলে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জন্য কাউকে এককভাবে দায়ী করাও ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, সম্পর্ক চলাকালীন দুজনেই তো দুজনের সঙ্গ উপভোগ করেছেন। তাহলে কেন এককভাবে পুরুষের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে? এমনকি এটাও বলা হয়ে থাকে (আমাদের সমাজে) যে নারী বৈবাহিক বন্ধন ছাড়াই শারীরিক সম্পর্কে জড়ান তিনি বিয়ের উপযুক্তই নন।

পাশ্চাত্যের বর্তমান মূল্যবোধ পুরোপুরি ভিন্ন। সেখানে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভনের ওপর নির্ভর করে না। সেখানে অনেক বছর প্রেম চলার পর, একত্রবাসের পর, এমনকি সন্তানের বাবা-মা হওয়ার পরও তাঁরা বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ নাও হতে পারেন।

সম্প্রতি ফুটবল তারকা মেসি বিয়ে করলেন তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে যিনি ইতোমধ্যেই তাঁর একাধিক সন্তানের জননীও বটে। দীর্ঘদিন প্রেমের পর, একত্রবাসের পর যদি কোনো জুটি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পুরুষটি যখন বিয়ের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে দেয় সেটা হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য বড় আনন্দের ঘটনা।

বিপরীতে নারী বা পুরুষটি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর অপর পক্ষ বিরক্তও হতে পারে। পাশ্চাত্যে এটা হতে পারে, কারণ, সেখানে প্রেম, একত্রবাস ও সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে কোনো নারীকে সমাজে ব্রাত্য ঘোষণা করা হয় না। বৈবাহিক বন্ধন ছাড়া কোনো নারীর সন্তান জন্মদানও খারাপ চোখে দেখা হয় না। মা-বাবার বিয়ে হোক বা না হোক সন্তানরা সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়েই বড় হয়। রাষ্ট্রও সেই সন্তানের সব অধি

প্রাচ্যে কিন্তু পরিস্থিতি আলাদা। আমরা আলোচনাটি বাংলাদেশের সমাজের প্রেক্ষাপটে সীমিত রাখব বলে প্রাচ্যের অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি উল্লেখ করছি না।

সাধারণত বাংলাদেশে যখন কোনো নারী (তিনি বিবাহিত হোন বা না হোন) কোনো পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান, তখন ভবিষ্যত নিশ্চয়তার একটা প্রসঙ্গ মনে ধারণ করেই জড়ান। ভবিষ্যতে বিয়ে অথবা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের বিষয়টি অনুল্লেখিত থাকলেও অবিদিত থাকে না।

কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘোরাফেরা বা মেলামেশা করছেন মানে ভবিষ্যতে তাঁরা একটা স্থায়ী সম্পর্ক গড়বেন– এমনটা ধরে নেওয়া হয়। কারণ, এটা যখন প্রকাশ্যে বা তাদের সামাজিক বন্ধুমহলে প্রকাশিত থাকে, তখন নারীর সম্মানের বিষয়টিও সেখানে থাকে। আমাদের সমাজে যখন একজন নারী প্রেমিকা পরিচয় দিয়ে একজন পুরুষের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা-মেলামেশা করেন, তখন ধরে নেওয়া হয় ভবিষ্যতে তাঁরা স্থায়ী সম্পর্কে যাবেন।

যদি তা না হয় তাহলে নারীটির সম্মানহানি হয়। সেই নারীর অন্যত্র বিয়ে হওয়া তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। নারী যদি বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত হন তাহলে যে পুরুষটির সঙ্গে তিনি প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করছেন, ধরে নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে তাঁরা বিয়ে করবেন বা স্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখবেন। সম্পর্ক ভেঙে গেলে নারীটির প্রবল বদনাম হয় এবং ‘সে তো অমুকের রক্ষিতা ছিল’– এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।

কোনো বিবাহিত নারী যখন অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান তখন তাঁর বর্তমান বিয়েটি অবধারিতভাবে ভেঙে যায় বা দাম্পত্য সম্পর্ক প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন সম্মান রক্ষার উপায় থাকে বিবাহবিচ্ছেদ এবং প্রেমিককে বিয়ে।

এখানে পুরুষের সম্মানের বিষয়টি উল্লেখ করছি না। কারণ, প্রেমের বা শারীরিক সম্পর্কের কারণে কোনো পুরুষের সম্মানহানি হচ্ছে– এমনটা আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে ব্যতিক্রম নিয়ে এখানে আলোচনা না হয় না-ই করলাম।

যদি বাঙালি সমাজে নারী-পুরুষ দুজনেই অবিবাহিত থাকেন তাহলে যেদিন থেকে প্রেমের সূচনা সেদিনই কিন্তু এমন একটি স্বপ্ন নারীটির মনে প্রোথিত হয়ে যায় যে, ভবিষ্যতে তাদের বিয়ে হবে।

প্রেমের এবং বিশেষ করে শারীরিক সম্পর্কে সম্মতিদানের সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে যায় অনুচ্চারিতভাবেই। অনুরূপ মূল্যবোধ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে বহাল ছিল। তখন কোনো নারীকে কোর্টশিপের পর অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে প্রেমের ঘোষণা দেওয়ার পর যদি তাঁকে বিয়ে না করা হত তাহলে নারীর গুরুতর সম্মানহানি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হত। সে ক্ষেত্রে ওই পুরুষকে ডুয়েলে ডাকতেন নারীর বাবা, ভাই বা অন্য কোনো আত্মীয়। বিবাহিত নারীর বেলায় যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গুজব জোরেশোরে উচ্চারিত হত তাহলে সেই কথিত প্রেমিককে ডুয়েলে ডাকতেন তাঁর স্বামী। বিখ্যাত রুশ কবি আলেকজান্দর পুশকিন এমন একটি ডুয়েলে মৃত্যুবরণ করেন।

পাশ্চাত্যে পঞ্চাশ এমনকি ষাটের দশক পর্যন্ত এমন মূল্যবোধ কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। রক হাডসন ও জিনা লো লো ব্রিজিতা অভিনীত ষাট দশকের কাম সেপ্টেম্বর ছবিটির কথা এ প্রসঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি। ওই ছবিতে মার্কিন কোটিপতি নায়ক এক আমেরিকান তরুণীকে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে যেতে নিষেধ করলেও নিজে তাঁর ইতালীয় প্রেমিকার সঙ্গে ঠিকই সে ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখেন। পরে অবশ্য তিনি প্রেমিকাকে বিয়ে করেন।

প্রেমে প্রতারণা, বিয়ের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে সম্পর্ক স্থাপন এগুলোকে যাঁরা অপরাধ বলে স্বীকার করেন না তাদের যুক্তি হল, দুজনেই যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকেন এবং পারস্পরিক সম্মতিতে যদি বিষয়টি ঘটে থাকে তাহলে তার দায়দায়িত্ব নারী-পুরুষ দুজনেরই। এখানে একপক্ষ চাইলে সম্পর্ক ভেঙে দিতেই পারে, যেহেতু আবেগের অনিশ্চয়তা কোনো অপরাধ নয়। দুজনেই যেহেতু সম্পর্ক ও পারস্পরিক সঙ্গ উপভোগ করেছেন তাই এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর প্রতারণার অভিযোগ করতে পারে না।

তাদের কথায় যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষভাবে এ যুক্তি সমর্থন করাই ঠিক। কিন্তু আমাদের সামাজিক পরিস্থিতিও তো বিবেচনা করতে হবে। যে সমাজে নারী-পুরুষ সমমর্যাদায় অবস্থান করেন সেখানে এই যুক্তি অবশ্যই চলতে পারে। যেখানে প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে না হলেও নারীর মর্যাদায় হেরফের হয় না বা তাঁর সম্মানহানি ঘটে না, ‘বদনাম রটে না’, সেখানে এ কথা অবশ্যই প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের সমাজে দুর্বলতর সামাজিক অবস্থানের কারণে নারী প্রতারিত সত্যই হয়।

উচ্চবিত্ত সমাজের নারীর বেলায় এ কথা যতটা সত্য তার চেয়ে অনেক বেশি সত্য হল মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক অবস্থানের নারীর বেলায়।

একজন দরিদ্র দিনমজুরের কন্যা বা শ্রমজীবী নারীকে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা পুরুষ যখন প্রেমের কথা বলেন, তখন অবধারিতভাবে নারীটিকে বিয়ের আশ্বাসও দেওয়া হয়। অথচ শারীরিক সম্পর্কের পর তাঁকে যখন আর বিয়ে করা হয় না, তখন তাঁর সামাজিক মর্যাদা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর সুন্দর সংসার গড়ার স্বপ্নটা ভেঙে যায় এবং জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়। ‘বদনাম যুক্ত’ মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করতে চায় না। আমরা এই প্রবণতাকে সমর্থন করছি না। কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করার তো উপায় নেই।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের কাছে প্রেম একটা ‘সাময়িক খেলা’র মতো হয়ে থাকে। অনেক পুরুষ নিছক শারীরিক সম্পর্ক গড়ার জন্যই প্রেমের কথা বলেন এবং মনে মনে সম্পর্কটি ভাঙার জন্য তৈরি থাকেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই তাঁর ভেতরে একটা দুরভিসন্ধি কাজ করে। নারীকে প্রতারণার সুপ্ত ইচ্ছা ভেতরে লালন করেই তিনি সম্পর্কে জড়ান। অথচ নারীর বেলায় সেটি ভবিষ্যৎ জীবনের সব পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে একজন পুরুষ যত সহজে সম্পর্ক ভেঙে নতুন সম্পর্কে জড়াতে পারেন আমাদের সমাজের বাস্তবতায় নারীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না।

প্রেমে প্রতারণার ক্ষেত্রে সাধারণত ধর্ষণ মামলা করা হয়। কিন্তু এটি প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু ধর্ষণের সঙ্গে শক্তি প্রয়োগের তথা জোরজবরদস্তির বিষয় আছে। বিষয় আছে মেডিক্যাল পরীক্ষার। মেডিক্যাল পরীক্ষায় প্রমাণ করা যায় নারীটি সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে অভ্যস্ত কি না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ধর্ষণজনিত আঘাতগুলো মেডিক্যাল পরীক্ষায় থাকে না বলে রিপোর্ট নারীটির বক্তব্যের বিপক্ষেই যায়।

এসব ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ প্রমাণ করা যায় না বলে মামলাগুলো ঝুলে যায়। বিচার পান না প্রতারিত নারী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রেমের প্রতারণাকে আইনের পৃথক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা গেলে এ ধরনের কার্যকলাপ রোধ করা সম্ভব হবে। এটি যদি সম্মানহানির আইনের আওতায় আসে তাহলে তা যুক্তিযুক্ত হয়। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক প্রমাণ করা সম্ভব হবে এবং সুনামহানির অপরাধে অপরাধীর শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রেমে প্রতারণা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি সামাজিক অপরাধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অপরাধের শিকার নারী। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষও এর শিকার হন।

আমরা নিশ্চিত লেখাটি এ পর্যন্ত পড়ে কিছু পাঠক ধর্মীয় অনুশাসনের প্রসঙ্গ তুলবেন। তাঁরা বলবেন নারী-পুরুষের মেলামেশার কারণেই এ ধরনের অপরাধ ঘটছে, অতএব নারীকে গৃহবন্দি করা হোক।

এই বক্তব্যধারীদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যেসব সমাজে নারী গৃহে আবদ্ধ থাকে সেখানেও এমন অপরাধ ঘটে। সেখানে নারীটি মামলা করতে সাহসী হয় না, কারণ, তাহলে ব্যভিচারের মামলায় ফেঁসে গিয়ে উল্টো তাঁরই মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেসব সমাজে ধর্ষণই প্রমাণ করা যায় না পুরুষের বিরুদ্ধে তো প্রেমজ শারীরিক সম্পর্ক! তাই ধর্মীয় ফর্মুলায় না গিয়ে বরং সমস্যাটির সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা উচিত যথাযথ আইনের মাধ্যমে।

মানুষের জীবনে প্রেম-অপ্রেম যা-ই হোক, প্রতিটি সম্পর্কই কিছুটা দায়িত্ব দাবি করে। যাঁরা এই দায়িত্বগুলো নিতে অক্ষম তাদের উচিত নয় সম্পর্কে জড়ানো। একপক্ষের দায়িত্বহীন সম্পর্কের জের অন্য পক্ষকে হয়তো বহন করতে হয় দীর্ঘসময় বা সারা জীবন। আর এই দায়িত্বহীনতা যখন হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, তখন তা প্রতারণা

দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে চিন্তা

দ্বিতীয় বিয়ে কিঃ

বিয়ে সবাই জীবনে একবারই করতে চায়।তবে সময় বা পরিস্থিতি সব সময় অনুকুলে থাকে না তাই তো ডিভোর্স বা স্বামী/ স্ত্রী বিয়োগের মত ঘটনাও ঘটে।আর তার পরই আসে দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গ ।

আমাদের সমাজে একের বেশি বিয়ে প্রচলিত রয়েছে। তবে ইদানিংকালে এই দ্বিতীয় বিয়ে যেন এক নিয়ম হয়ে গেছে।দেশে যেমন বেড়েছে ডিভোর্সের হার তেমনি দ্বিতীয় বিয়ের সংখ্যাও কম নয়।

কেন এই দ্বিতীয় বিয়েঃ

সংসার নানা কারনে ভেঙ্গে যেতে পারে, তবে আমাদের সমাজে একটি ছেলের ডিভোর্স সমাজ যত সহজে মেনে নেয় ।ডিভোর্সি একটি মেয়েকে ততটা সহজ ভাবে মেনে নেওয়া হয়না । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করা হয়।

তবে বাস্তবতা হল জীবনের সব ক্ষেত্রে সব কিছু আমাদের মনের মত্ন হয় না ।কখনো কখনো মানিয়ে ও নিতে হয় দিতে হয় ছাড় ।কিন্তু এভাবে ছাড় দিতে দিতে আর মানিয়ে নিতে গিয়ে যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দেয় যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ঠিক সেই মুহূর্তেই আসে ভাঙ্গনের ঢেউ । দুটি মানুষের দুটি পথ হয় আলাদা।

তবে পরিবার কাউকে একাকী জীবন পার করতে দেয় না,তবে অনেকে নিজ উদ্যোগেও পুনরায় সঙ্গী খুঁজে নেয়।

একথাও ঠিক একাকী জীবন পার করা খুব কঠিন।তবে একথাও ঠিক এমন অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন একাই কাটিয়ে দেন।কিন্তু একাকী সেই জীবনে থাকে না রঙ। কেউ কেউ আবার এক বার ঘর ভাঙ্গার পর আর ঘর বাঁধতে চান না পাছে আবার এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়…।

এমন ধারনা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসা উচিৎ কারন জীবনে আপনার সব সিধান্ত যে ভুল হবে তেমন না। হয়ত আপনার জন্য যিনি সঠিক তার সাথে দেখা হয় নি সঠিক মানুষটি হয়ত আছে আপনারই অপেক্ষায়।

পুরুষের ২য় বিয়ের ক্ষেত্রে করণীয়ঃ

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী,একজন পুরুষ একের অধিক বিয়ে করতে পারবে তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে।অর্থাৎ  কোনো ব্যক্তির স্ত্রী বর্তমান থাকাকালে আরেকটি বিয়ে করতে চাইলে , তাকে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের মধ্যে সর্বশেষ স্ত্রীর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে আরেকটি বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হবে।বিয়ের অনুমতি পেলে তবে সে বিয়ে করতে পারবে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর ৬ ধারা অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিসি পরিষদের কাছে অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করলে সেই বিয়ে নিবন্ধন হবে না।এবং উক্ত অনুমতি পাবার জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি দিতে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা হবে।

যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হবেঃ

১. বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব

২.মারাত্মক শারীরিক দুর্বলতা

৩.দাম্পত্যজীবন সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা

৪.দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য আদালত থেকে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা ডিক্রি বর্জন ও

৫. মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি।

আর কোনো পুরুষ যদি সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তবে তিনি অবিলম্বে তাঁর বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের পাওনা দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা  সাথে সাথে পরিশোধ করতে হবে।এই পর্যায়ে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীরা  আদালতে মামলার  মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের সম্পূর্ণ অধিকার পাবেন ।আর দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে প্রথম স্ত্রী যদি তার স্বামীর থেকে  আলাদা বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তবে সে৩ ক্ষেত্রেও  তিনি স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন। এ ক্ষেত্রে নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণও তাদের বাবাকেই দিতে হবে ।শুধু তাই নয়  ভরণপোষণের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানদের উত্তরাধিকারীর অধিকারও বজায় থাকবে  কোনো অবস্থাতেই সে অধিকার  খর্ব হবে না। এ ছাড়া ২য় বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামীর  অনুমতি না নেওয়ার বিষয়টি প্রমানিত হলে এই অভিযোগে স্বামী  দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত জেল ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সেই সাথে ২য় বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে।

নারীর দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে করনীয়ঃ

বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী, ১ম  স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় স্ত্রী যদি আবারও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে আইনত অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।যদি কোন  স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায় তাহলে তাঁকে অবশ্যই প্রথম স্বামীর সঙ্গে যথাযথ আইন মেনে বিবাহবিচ্ছেদ করে নিতে হবে। স্ত্রী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে,স্ত্রী তার প্রথম স্বামীকে তালাকের উদ্দেশ্য পর পর ৩ বার ইউনিয়ন পরিষদ/ জেলা/ সিটি কর্পোরেশনের  চেয়ারম্যন/কাউন্সিলর / কমিশনার এর কার্যালয়ে নোটিশ প্রদান করবেন।স্ত্রী কর্তৃক এই নোটিশ প্রদানপূর্বক ৯০ দিন ইদ্দত পালন শেষে তালাক কার্যকর হয়।পর পর এই তিনটি নোটিশ দেবার পর স্বামী যদি তালাক নামায় সাক্ষর নাও করেন তার পরও তালাক কার্যকর হবে। আর এর পর ই একজন স্ত্রী  এই আইনগত বিধান মেনে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে ।

যদি কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বিয়ে করেন, সে ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী তার  স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দন্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে আর্থিক জরিমানাও হতে পারে ।

তবে স্ত্রী যদি তাঁর ১ম স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন যোগাযোগ না থাকে অর্থাৎ  স্বামীর যদি সাত বছর যাবৎ কোনো খোঁজখবর না থাকে, অথবা তিনি জীবিত থাকতে পারেন—এমন কোনো তথ্য  জানা না যায়, তাহলে পরবর্তী স্বামীকে সকল সত্যি ঘটনা জানিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। এটি দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারার বিধানের ব্যতিক্রম আর এই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য আপরাধ বলে গণ্য হবে না।

অন্যদিকে স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় যাকে বিয়ে করছেন, তাঁর কাছে তার অতীতের সব কথা অর্থাৎ  পূর্বের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলে সেটিও  দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং আর্থিক জরিমানা।

২য় বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানঃ

ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আমরা কিভাবে আমাদের জীবন অতিবাহিত করব তার সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে পবিত্র কুরআনে ।

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী একজন পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু তার জন্য রয়েছে সমতার শর্ত ।সকল স্ত্রীর  সমান অধিকার নিশ্চিত করন। ভরণপোষণ, আবাসন ও শয্যাযাপনের ক্ষেত্রে শতভাগ সমতাবিধান নিশ্চিত করা না গেলে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ইসলামে বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী বা নারীদের ক্ষেত্রে এই রকম কোন শর্ত রাখা হয়নি  ।ইসলামে বলা হয়েছে যে স্ত্রী  আগের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইদ্দত শেষে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারবেন।

পুরুষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য এমন : ‘…তোমরা বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে—দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে (বিয়ে করো)…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩)

করণীয় সেরা  টি উপদেশ

২য় বিয়ে করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই পাঁচটি উপদেশ

১। প্রথম স্বামী বা স্ত্রীকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তালাক প্রদান

২। দেনমোহর পরিশোধ করা ।

৩।নতুন সম্পর্কে পা দেবার আগেই পূর্বের বিয়ের ব্যাপারে অবগত করা।

৪। নিজের সম্পর্কে জানা, অতীতের ভুলের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং ৫ বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার মত মানুষিক শক্তি সঞ্চয় ।

৫।নিজ মনে বিশ্বাস করা শেষ থেকেও নতুন করে শুরু করা যায়।

পরিশেষ

জীবনে আমাদের অনেক ঘটনারই সাক্ষী হতে হয়। তার ভেতর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও থাকে।তবে ডিভোর্সের মত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কখনই হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত নয়।মনে রাখতে হবে ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব হারিয়েও নতুন করে সুরু করা যায়।

matrimony marriage profile

about matrimonial sites

best matrimony profile

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here